আজ শনিবার

৬ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

২২শে ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

১৪ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

এখন সময়:

রাত ১২:৫৭

মেঘনা নদীতে ভয়াবহ দূষণ, ইলিশের আকালে অস্থির বাজার

105 Views

বাংলাদেশের জীবনরেখা হিসেবে পরিচিত পদ্মা ও মেঘনা নদী আজ এক গভীর সংকটের মুখোমুখি। ভরা মৌসুমেও পদ্মা-মেঘনায় কাঙ্ক্ষিত ইলিশের দেখা মিলছে না, যা স্থানীয় মৎস্যজীবী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে তীব্র হতাশার জন্ম দিয়েছে। মাছের আকাল এতটাই প্রকট যে, বাজারে ইলিশ এখন সোনার হরিণ, যার দাম অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। নদী দূষণ, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন এবং বাল্কহেডের অনিয়ন্ত্রিত চলাচলকেই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

স্থানীয় মাছের আড়ৎ ও বাজারগুলো ঘুরে দেখা গেছে এক হতাশাজনক চিত্র। ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে এক কেজি ওজনের ইলিশ ২৮০০ থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা পূর্বে অস্বাভাবিক ছিল। ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রামের ইলিশের দাম ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং ৬০০ থেকে ৭০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকায়। ইলিশের এই আকাশছোঁয়া দাম সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে, এবং বাজারে মাছের সরবরাহ একেবারেই নগণ্য।

মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকার বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীর দূষিত পানি মুন্সীগঞ্জ হয়ে চাঁদপুরের মেঘনা নদীর মোহনা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এই দূষিত পানি ইলিশের সাগর থেকে নদীতে প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করছে। এছাড়া, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার মেঘনা নদীর পাশেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য শিল্পকারখানা, যেগুলোর বর্জ্য সরাসরি মেঘনা ও তার শাখা নদীগুলোতে ফেলা হচ্ছে, যা দূষণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
পদ্মা নদীতে বালুবাহী বাল্কহেডের অনিয়ন্ত্রিত চলাচলও দূষণের অন্যতম কারণ। দিনরাত অসংখ্য বাল্কহেড বালু পরিবহনে ব্যস্ত, যার ধোঁয়া এবং ইঞ্জিনের তেল সরাসরি নদীতে মিশে পানিকে আরও বিষাক্ত করে তুলছে।

জেলেদের অভিযোগ, পদ্মা নদীর গভীরতা কমেছে এবং ভাসানচরের মুখে নাব্যতা সংকটের কারণে ইলিশের মূল প্রবেশপথগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পদ্মা-মেঘনায় ইলিশের এই সংকট কেবল একটি অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি পরিবেশগত বিপর্যয়ের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। ইলিশ মাছ সাধারণত ডিম ছাড়ার জন্য এবং অনুকূল পরিবেশের সন্ধানে সাগর থেকে নদীতে আসে। নদীর পানির গুণগত মান এবং অক্সিজেন লেভেল ইলিশের জীবনচক্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার মতো দেশের অন্যতম দূষিত নদীর পানি পদ্মা-মেঘনায় এসে মিশছে, তখন এই নদীর বাস্তুতন্ত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিল্পকারখানার বর্জ্য এবং বাল্কহেডের তেল মিশে নদীর পানিকে ইলিশের বসবাসের অনুপযোগী করে তুলছে।

মৎস্য বিজ্ঞানীরা বলছেন, নদীর দূষণ, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং নদীর আয়তন বেড়ে যাওয়ায় জেলেরা জাল ফেলতে না পারায় মাছ পাচ্ছে না। তবে জেলেদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জানা যাচ্ছে, নদী দূষণ এবং ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্রে নাব্যতা সংকটই মূল সমস্যা। জেলে জাকির হালদার এবং দুলাল মোল্লার মতো অসংখ্য জেলে দিনের পর দিন নদীতে জাল ফেলেও ইলিশের দেখা পাচ্ছেন না, যা তাদের জীবিকাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। দিঘিরপাড় মাছ আড়ৎ এর আড়তদার মিজান খান জানান, এমন পরিস্থিতি আগে কখনোই দেখেননি। এটি স্পষ্ট যে, এই সংকট সাময়িক নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত সমস্যার ফসল।

মৎস্য কর্মকর্তারাও নদী দূষণকেই ভরা মৌসুমে ইলিশ না পাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই পরিস্থিতি মৎস্যজীবীদের মধ্যে চরম হতাশা সৃষ্টি করেছে। হাজার হাজার জেলে পরিবার, যারা ইলিশ ধরার উপর নির্ভরশীল, তারা এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে। বাজারে ইলিশের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ মানুষের পাতেও ইলিশের স্বাদ মেলা কঠিন হয়ে পড়েছে। এই সংকট সারাদেশের ইলিশ সরবরাহ এবং অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

পদ্মা-মেঘনায় ইলিশের আকাল একটি বহুমুখী সমস্যার ইঙ্গিত দিচ্ছে, যেখানে পরিবেশ দূষণ, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন এবং বাল্কহেডের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল প্রধান ভূমিকা পালন করছে। এই সংকট মোকাবিলায় সরকারের দ্রুত এবং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। শিল্পবর্জ্য নিষ্কাশনে কঠোর নীতিমালা প্রয়োগ, বাল্কহেডের চলাচল নিয়ন্ত্রণ এবং নদী পরিষ্কার রাখতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। অন্যথায়, ইলিশের মতো জাতীয় সম্পদ হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমাদের স্মৃতি হয়েই থাকবে, এবং এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর।

Share This Article
Leave a Comment

শেয়ার করুন:

শীর্ষ সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ