আজ শনিবার

২রা আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

১৮ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

৮ই সফর, ১৪৪৭ হিজরি

এখন সময়:

রাত ১০:৪৩

মায়ের ওষুধ কিনতে গিয়ে গুলিতে শহীদ হন মতলবের সৈকত

116 Views

সৈকত চন্দ্র দে সুমন (৪৩)। রাজধানীর শনির আখড়া বাজারের রুপসী গার্মেন্টস গলিতে পরিবার নিয়ে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। গেল বছর ২০ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মায়ের জন্য ঔষধ কিনতে যান ফার্মেসীতে।

একহাতে ছিলো মোবাইল এবং অপরহাতে মায়ের প্রেসক্রিপশন আর ঔষধ। ঠিক ওই সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলের গোলাগোলির মধ্যে সুমনের বুকের পাঁজরে গুলি লেগে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন।

সুমন শনির আখড়ায় থাকলেও তার বাড়ি চাঁদপুরে। তিনি জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলার উপাদি উত্তর ইউনিয়নের উপাদি গ্রামে সূত্রধর বাড়ি। তার বাবা স্বর্গীয় দুলাল চন্দ্র দে। তিনি পেশায় ছিলেন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মা স্বর্গীয় শিখা রানি দে ছিলেন গৃহিনী। সুমনসহ ছিলেন ৩ ভাই এবং এক বোন। সুমনই ছিলো সবার বড়। মেঝো সুজন চন্দ্র দে (৩৫)। তিনি ঢাকায় অংলকার তৈরীর কারখানায় কাজ করেন। ছোট ভাই চন্দন চন্দ্র দে (৩২)। তিনি রাজধানীর আনন্দ হাউজিংয়ে এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত। বোন মৌসুমী রানী দে (৪০)। তাকে বিয়ে দেয়া হয়েছে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায়।

শহীদ সৈকত চন্দ্র দের ছোট ভাই চন্দন চন্দ দে বলেন, তিনি এবং তার ভাই সুমন পুলিশের অবসপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রতিষ্ঠান মতিঝিল আনন্দ হাউজিংয়ে চাকরি করেন। কোম্পানীতে হিসাব রক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন ২০১৬ সাল থেকে। তিনি জীবনে অনেক কষ্ট করে সর্বশেষ অবস্থানে পৌঁছান। কারণ আমার বাবা স্কুল শিক্ষক হলেও আয় ছিলো খুবই কম। কারণ তিনি প্রতিবন্ধী ছিলেন। যে কারণে আমাদের ভাই-বোনদের বড় করার জন্য ভাই আমাদের দায়িত্ব নেন। তিনি ছাত্রাবস্থায় টিউশন পড়িয়ে আমাদেরকে সহযোগিতা করেছেন।

শহীদ সৈকত চন্দ্র সুমন এর জন্ম ১ মে ১৯৮১খ্রি.। ১৯৯৭ সালে নিজ এলাকার বোয়ালিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৯৯ সালে মতলব ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ২০০২ সালে একই কলেজ থেকে বি.কম পাশ করেন। তিনি খুবই মেধাবি ছিলেন। ২০০৩ সালে আকিজ গ্রুপে, ২০০৫ সালে গ্রামীণ ব্যাংকে, ২০০৮ সালে স্কয়ার টেক্সটাইল, ২০১১ সালে ব্র্যাকে এবং ২০১৫ সালে শনির আখড়ায় একটি বিদ্যালয়ে এবং সর্বশেষ আনন্দ হাউজিংয়ে হিসাব রক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। সংসারের আয় বৃদ্ধির জন্য একই সাথে তিনি সন্ধ্যার পরে শনির আখড়ায় গনিত ও ইংরেজি বিষয়ে তিনটি টিউশনি করতেন। শুধু তাই নয়, নিজ সন্তানদের গনিত ও ইংরেজি তিনি নিজে পড়াতেন। অন্য বিষয়ের জন্য একজন শিক্ষক ছিলো।

শহীদ সুমনের মেঝো ভাই সুজন চন্দ্র দের কাছে তার ভাই সম্পর্কে জানতে চাইলে শুধু কান্না করতে থাকেন। ভাইয়ের স্মৃতি মনে করে তিনি কথা বলতে খুবই কষ্ট হচ্ছিলো।
তিনি বলেন, জুলাই মাসের ৮ তারিখে তার সাথে মোবাইল ফোনে সর্বশেষ সুমনের কথা হয়। ভাই তাকে আন্দোলন থেকে দুরে থাকার জন্য সতর্ক করেন। কারণ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নিউ মার্কেট এলাকায় থাকতাম। তিনি আমার বড় ভাই হলেও বন্ধুর মত ছিলো সম্পর্ক। তিনি আমাদেরকে বাবার অভাব বুঝতে দেননি। সব সময় সকল বিপদে আপদে এগিয়ে আসতেন।

সুজন চন্দ্র দে আরো বলেন, আমার মা ভাইয়ের বাসায় থাকতেন। মায়ের জন্য ঔষধ কিনতে গিয়ে ভাই শহীদ হন। ভাইয়ের মৃত্যু শোকে ৭ মাস পর মায়েরও মৃত্যু হয়। বাবার মৃত্যু হয় আরো আগে। আমরা সবাই অভিভাবকহীন হয়ে পড়ি। আমাদের পরিবারের এমন পরিস্থিতিতে আমার বড় ভাই শহীদ সৈকত চন্দ্র দের স্ত্রী স্বপ্না রাণী দে, ভাতিজা দ্রুব চন্দ্র দে (১২) ও মাতৃকা রাণী দে (৮) কে নিয়ে বাবার বাড়ি রংপুরে চলে যায়।

শহীদ সৈকত চন্দ্র সুমন স্বপ্না রানীর সাথে প্রেম করে ২০১২ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার পিতার নাম সতিস চন্দ্র গোলদার। পেশায় ছিলেন কৃষক। মাতা কুসুমী রাণী গোলদার ছিলেন গৃহিনী। তখন তাদের অবস্থান ছিলো কুমিল্লা জেলার বুড়িচং থানার কংশনগর গ্রামে। তাদের আদি নিবাস রংপুর জেলায়।

শহীদ সৈকত চন্দ্র সুমনের স্ত্রী স্বপ্না রাণী দে বলেন, আমার শ্বাশুড়ি অসুস্থ থাকার কারণে গ্রাম থেকে আমাদের বাসায় আসেন জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। মার সুস্থ্যতার জন্য কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসা করান। তখন দেশে ছাত্র-আন্দোলন চলছিলো। ঘটনার দিন ২০ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে শনির আখড়া বাজারের প্রধান সড়কে মায়ের ঔষধ হাতে নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। ঠিক ওই সময় ছাত্র-পুলিশের গোলাগুলির মধ্য থেকে গুলি এসে পড়ে সমুনের বুকের পাঁজরে। ঘটনাস্থলেই তিনি লুটিয়ে পড়েন এবং মৃত্যুবরণ করেন। স্থানীয় লোকজন তার মরদেহ পাশের গলিতে এনে রাখেন।

তিনি বলেন, তার মৃত্যুর সংবাদ পাই আমার বান্ধবির ফোন থেকে। কারণ মৃত্যুর পূর্বে সুমনের মোবাইল থেকে তার সাথে কথা বলি। তাৎক্ষনিক আমি ঘটনাস্থলে ছুটে যাই এবং তার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখি। লোকজন বলাবালি করে সুমনের মৃত্যু হয়েছে এবং লোকজন বাসায় নিয়ে যায়। পরদিন ভোরে তার মরদেহ যাত্রাবাড়ী থানায় নেয়া হয়। সেখানে পুলিশ তার ময়না তদন্তও করেনি এবং জিডিও নেয়নি। যার কারণে প্রতিবেশিদের সাথে পরমার্শ করে মরদেহ বাড়িতে এনে সতকার করি এবং ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শ্রাদ্ধ সম্পাদন করে বাসায় চলে আসি।

স্বপ্না রাণী বলেন, সুমনের মৃত্যুর পর আমাদের ঘরে ছিলো ২৫০টাকা। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের আত্মীয়স স্বজন, তার কোম্পানী ও স্থানীদের সহযোগিতায় কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর সবকিছুই বন্ধ হয়ে যায়। ছেলে শনির আখড়া বর্ণমালা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি এবং মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কোন রকম সন্তানদের পড়ালেও আর এগুতে পারেনি। যে কারণে জানুয়ারি মাসে এসে বাবার বাড়িতে চলে যাই। এখন মায়ের সাথে বাবার বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। কারণ মতলবে আমার স্বামীর কোন সম্পত্তি নেই। তারাই থাকতেন নানা বাড়ির আশ্রয়ে।

তিনি বলেন, সুমনের মৃত্যুর পর সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই ফাউন্ডেশন এবং ডিসির পক্ষ এ পর্যন্ত ৭লাখ টাকা পেয়েছেন। এছাড়াও ঢাকায় জামায়াতে ইসলামী থেকে পেয়েছেন ২লাখ এবং বিএনপির পক্ষ থেকে ৫০হাজার টাকা। সর্বশেষ জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পেয়েছি। এসব আর্থিক অনুদানের টাকা থেকে পারিবারিক খরচ এবং সন্তানদের লেখা পড়ার খরচ চালিয়ে আসছি। সন্তানদেরও রংপুরে পড়াতে হচ্ছে। আমি নিজে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য হলেও আমার কোন কর্মসংস্থান হলে সংসারের হাল ধরে রাখা সম্ভব হবে।

সুমনের একমাত্র ছেলে দ্রুব চন্দ্র দে বলেন, বাবার স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার বানাবে। তিনি বলতেন বিকেএসপিতে ভর্তি করাবেন। বোনকে চিকিৎসক বানানোর কথা বলতেন। বাবার মৃত্যুতে আমাদের সব স্বপ্ন শেষ। কীভাবে কারা বাবাকে মেরেছে আমরা জানি না। তবে বাবার মৃত্যুর সঠিক বিচার দাবী করছি।

শহীদ সুমনের প্রতিবেশি বিউটি আচার্য্য বলেন, এই পরিবার খুবই শান্ত ছিলো। সুমনের বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। সুমনের বিয়ের পরে মাঝে মাঝে ঢাকা থেকে বাড়িতে আসতেন বেড়াতে। মৃত্যুর পরে তার স্ত্রী বাবার বাড়ি চলে যায়। সাত মাস পরে গত রমজান মাসে ছেলে শোকে সুমনের মায়েরও মৃত্যু হয়। বসত ঘরের পাশেই মা-ছেলের শেষকৃত্য (সতকার) সম্পন্ন হয়।

শহীদ সুমনের গ্রামের পারিবারিক চিকিৎসা দিতেন পল্লী চিকিৎসক সুদর্শন পাল। তিনি বলেন, সুমনের মৃত্যুর সংবাদে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। কারণ সে ছাত্রজীবনে এলাকার অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে পড়াতেন। যে কারণে তার পরিচিত ছিলো। আমাদের উপস্থিতিতে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। আমারা জানামতে তাদের পরিবার ছিলো খুবই শান্তিপ্রিয়।

Share This Article
Leave a Comment

শেয়ার করুন:

শীর্ষ সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

error: Content is protected !!