প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ঐতিহ্যের কারণে কাচিয়ারা গ্রামকে স্থানীয় লোকজন কাঞ্চন দিঘির গ্রাম হিসেবেও পরিচিত। প্রায় ৪০০ বছর আগের কথা। ভারতবর্ষে তখন মোগল শাসনামল চলছে।
জনশ্রুতি আছে, ওই সময় রাজা কাঞ্চন চন্দ্র সাধারণ প্রজা ও রাজ্যের নানা কাজের সুবিধার জন্য এক বিশাল দিঘি খনন করেন। ওই রাজার নামানুসারে দিঘিটির নাম হয় কাঞ্চন রাজার দিঘি বা কাঞ্চন দিঘি। তবে এই দিঘির নামকরণ নিয়ে মতপার্থক্যও আছে।
প্রচলিত জনশ্রুতি হলো, এই দিঘিতে গোসল করতে নেমে কাঞ্চনমালা নামের এক কিশোরী হারিয়ে যায়। স্থানীয় ব্যক্তিদের মুখে রটে, দিঘিতে দেবতার ‘ভোগ’ হিসেবেই ওই কিশোরীর বলি হয়েছে। তখন থেকে স্থানীয় মানুষের কাছে এটি কাঞ্চনমালার দিঘি হিসেবেও পরিচিতি পায়।
চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার উত্তর নায়েরগাঁও ইউনিয়নের কাচিয়ারা গ্রামে কাঞ্চন দিঘির অবস্থান। স্থানীয় একাধিক প্রবীণ লোকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। বিশাল আয়তন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ঐতিহ্যের কারণে কাচিয়ারা গ্রামকে স্থানীয় লোকজন কাঞ্চন দিঘির গ্রাম হিসেবেও চেনে। দিঘিটিকে জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক বলে মনে করা হয়। এটি জেলার ব্র্যান্ডিং হিসেবেও অন্তর্ভুক্ত।
দিঘি ঘুরে দেখা গেছে, দিঘির তিন দিকে লোকালয়। এক পাশে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ছায়াঘেরা দিঘিটিতে স্থানীয় কিছু লোক গোসল করছেন। ধোয়ামোছাও করছেন কেউ কেউ। ঝাঁকে ঝাঁকে বালিহাঁস ও পানকৌড়ি দিঘির পানিতে সাঁতার কাটছে। দিঘির পাড়ে বসে বেশ কিছু দর্শনার্থী ছবি তুলছেন। প্রাচীন এই দিঘিকে ঘিরে প্রচলিত আছে নানা উপকথা আর কল্পকাহিনি।
উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্র জানায়, কাঞ্চন দিঘি একটি বেসরকারি দিঘি হিসেবেই স্থানীয় ভূমি কার্যালয়ে খতিয়ানভুক্ত। এটির আয়তন প্রায় ১৩ একর। প্রায় আধা কিলোমিটার দীর্ঘ ও প্রস্থে ১ হাজার ২০০ ফুট।
উপজেলা প্রশাসন সম্পাদিত ‘মতলবের ইতিবৃত্ত’ নামের স্থানীয় একটি ইতিহাসগ্রন্থের ২৪০ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘নায়েরগাঁও উত্তর ইউনিয়নে কাচিয়ারা একটি কিংবদন্তির গ্রাম। এ গ্রামের কাঞ্চনমালা মতান্তরে কাঞ্চন রাজার দিঘি নামে একটি প্রকাণ্ড দিঘি রয়েছে। দিঘিটির পাশে রাজবাড়ির অনেক ধ্বংসাবশেষ আছে। আনুমানিক ৪০০ বছর পূর্বে দিঘিটি খনন করা হয়। দিঘিটির পানি সেচে কমানো যায় না। রাজা বা জমিদারদের বিলাসিতার অনেক চিহ্ন আছে সেখানে।’
কাচিয়ারা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সরকার সোহেল আহম্মেদ জানান, এই দিঘি ঘিরে নানা উপকথা ও কল্পকাহিনি প্রচলিত আছে। ব্রিটিশ আমলে স্থানীয় লোকজন মাতৃদুগ্ধরূপে এই দিঘির পানি পান করতেন বলে শোনা যায়। বর্তমানে এই এলাকার বাসিন্দারা গোসল, থালা–বাসন ধোয়াসহ নানা প্রাত্যহিক কাজে এই দিঘি ব্যবহার করছেন।
সোহেল আহম্মেদ বলেন, কাঞ্চন দিঘির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য সারা বছরই এখানে লোকজন বেড়াতে আসেন। বিশেষ করে শীতকালে এখানে প্রচুর দর্শনার্থী ভিড় করেন। এই দিঘিকে কেন্দ্র করে এই এলাকায় আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে।
স্থানীয় প্রশাসন জানায়, মোগল ও ব্রিটিশ আমলের অনেক ঐতিহ্যের স্মারক এই কাঞ্চন দিঘি। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রেও এটি কার্যকর ভূমিকা রাখছে। দিঘিটি যথাযথভাবে সংরক্ষণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে যা যা করা দরকার, সেটি করা হবে।