প্রকাশের তারিখঃ ৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ | প্রিন্ট এর তারিখঃ ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১১:২৩ অপরাহ্ণ

আজ ঐতিহাসিক ‘মতলব মুক্ত’ দিবস

প্রতিবেদকঃ মাহফুজুর রহমান

চাঁদপুরের মতলব আজ পালন করছে ঐতিহাসিক মতলব মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মতলবের মাটি ছাড়তে বাধ্য হলে মুক্ত হয় পুরো অঞ্চল। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নারীনির্যাতনের বিভীষিকা শেষে এদিনেই মুক্তির আনন্দে ফেটে পড়ে মতলববাসী।

১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল ঢাকার দিক থেকে সড়কপথে পাকিস্তানি সেনারা মতলবে এসে থানা দখল করে সামরিক ক্যাম্প স্থাপন করে। এর পরপরই সাধারণ মানুষের ওপর চালানো হয় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। পাকসেনা ও তাদের দোসর রাজাকারদের সহযোগিতায় এনায়েতনগর গ্রামে প্রায় পাঁচ হাজার ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় এবং বহু নারী ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন।

হানাদার বাহিনীর এই বর্বরতার বিরুদ্ধে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কবির আহমদের নেতৃত্বে খিদিরপুর, বহুরী, বাগানবাড়ি, মোহনপুর ও এনায়েতনগর এলাকায় পাঁচটি ঘাঁটি স্থাপন করে সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

মতলব ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় এই সময় কয়েকটি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এর মধ্যে ১২ আগস্ট নন্দলালপুর বাজার যুদ্ধে লে. এম এ ওয়াদুদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হন। সেপ্টেম্বরের শুরুতে কমান্ডার সেলিম খান ও শহীদুল আলম রবের নেতৃত্বে মেঘনা নদীতে পাকসেনাদের তিনটি মালবাহী জাহাজে আক্রমণ চালানো হলে ‘এম ভি গফুর’ ও ‘এম ভি সোবহান’ জাহাজ দুটি ডুবে যায় এবং ‘এম ভি মাসুদ’ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।

২৫ সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী এনায়েতনগর–সিপাইকান্দি এলাকায় হামলা চালালে কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম এবং পরে এম এ ওয়াদুদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিত আক্রমণ চালান। সারাদিনের গোলাগুলির পর পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে উভয় পক্ষেই হতাহতের ঘটনা ঘটে।

২০ নভেম্বর গোয়ালমারী (দাউদকান্দি) মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পাকবাহিনীর আকস্মিক আক্রমণের পর প্রায় ২০ ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক পাকসেনা নিহত হয় এবং মেজর আল আমিনসহ কয়েকজন ধরা পড়ে। এ যুদ্ধে সাতজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং কমান্ডার এম এ ওয়াদুদসহ ১৭ জন আহত হন।

২২ নভেম্বর মোহনপুর ইউনিয়নের নাছিরাকান্দি এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকসেনাবাহী ‘লিলি’ নামের গানবোটটি ডুবে যায়। সাতজন পাকসেনা জীবিত অবস্থায় ধরা পড়ে।

৪ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন কমান্ড একযোগে চারদিক থেকে মতলব থানা ক্যাম্পে আক্রমণ চালালে পাকিস্তানি সেনারা পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে নদী ও সড়কপথে পালিয়ে যায়। এদিনই মতলব হানাদারমুক্ত হয়।


৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর শহর ছাড়ার চেষ্টা করলে মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় মোহনপুর এলাকায় পাকসেনাদের জাহাজ ডুবে যায়। কালিপুর বাজারের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণ ও বিমান হামলায় একটি গানবোট ডুবে যায় এবং দুইটি আটকা পড়ে। পরে পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে এবং তাদের অস্ত্র-গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মতলব অঞ্চলে অন্তত ৩০ জনের বেশি মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, যাদের বীরত্ব ও আত্মদান আজও মতলববাসীর হৃদয়ে অম্লান হয়ে আছে।


মতলব মুক্ত দিবস উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে দিনব্যাপী কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালা।

মতলববাসী আজ গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছে সেই সব বীর মুক্তিযোদ্ধাকে, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়েছিল এই জনপদে।

পাশাপাশি এই গৌরবময় দিনে মতলব টুডে ডটকম গভীরভাবে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে সেই সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ এবং যুদ্ধকালীন সময়ে নির্যাতিত পরিবারের প্রতি, যাদের ত্যাগ ও বীরত্বের বিনিময়ে আজকের মতলব স্বাধীনতার আলো দেখেছিল।